শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১২

রামুর ন্যাড়া এবং আত্মঘাতী ন্যাড়ারপো'দের কান্ড

রাজু আহমেদ মামুন
সম্পাদক
ঢাকা রিপোর্ট ২৪ ডট কম




প্রাচীন বঙ্গবিশ্বে ব্রাহ্মণরা মুন্ডিত মস্তক বৌদ্ধ ধর্মগুরু শ্রমনদের গালী দিত ন্যাড়া বলে, পাষান্ড বলে। হিন্দু বাঙ্গালীরা আজও মুসলমান বাঙ্গালীদের গালীদেয় ন্যাড়ারপো বলে। মুসলিম পূর্ব সেই সাম্প্রদায়ীক যুগে বাংলার অধিকাংশ মানুষ ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, আজ যেমন মুসলমান ।
সম্প্রতি রামুতে ন্যাড়া এবং ন্যাড়াপো'দের যে আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িক কান্ড ঘটেছে সে বিষয় ভাবার আগে  আসুন বাংলার ধর্মের ইতিহাসটা একটু যেনে নিই।
বিশাল বাংলাকে বলা যায় হিমালয়ের বেসিং। প্রচীন বঙ্গ ভূমিতে অনেক লোকধর্মের বিকাশ ও বিস্তার হয়েছিল। যেমন- শৈব, শাক্ত, মৎস, আজিবক, বৌদ্ধ সহ নানা রকম কৌম ধর্ম।
আজ স্পষ্টই চারটি বৃহৎ ধর্মীয় ব্যানারে বিভক্ত বাঙ্গালীরা। প্রধানত ইসলাম এবং হিন্দু। আর বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মানুশারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। হিন্দু ধর্ম আজ যে রূপ পরিগ্রহ করেছে মুসলিম পূর্বযুগে এমন ছিলনা। মূলতো মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়(ব্রাহ্মণ কতৃক নির্ধারীত)পতীত সম্প্রদায় নিয়ে হিন্দুধর্ম রূপলাভ করে।
হাজার নদী পরীবেস্টিত প্রচীন বাংলার অধিবাসীরা বিচ্ছিন্ন ভাবে স্বাধীন গনতান্ত্রিক কৌম সমাজে বাস করতো। যে কারনে বহিরাগতদের ধর্ম এখানে খুব একটা বিস্তার লাভ করতে পাবেনি। যারা ব্যার্থ হয়েছে তাদের অনেকেই ব্যপক কুৎসা রটিয়েছে আমাদের দেশ এবং জাতি সম্পর্কে।
বিশেষ করে হিন্দু ধর্মীয় প্রাচীন সাহিত্যগুলো খুঁজলে পাওয়া যাবে এসব কুৎসা। এদেশের ভাষাকে উল্লেখ করা হয়েছে পক্ষীর ভাষা বলে। মানুষদের বলা হয়েছে রাক্ষস। আবার শুদ্ধকরার জন্য কোন লম্পট মুনির জারজ সন্তান হিসাবেও পরিচিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বাঙ্গালীদের। জৈন তির্থাঙ্কর মহাবীর এদেশে ধর্ম প্রচার করতে এলে কৌমের লোকজন তার বিরুদ্ধে কুত্তা লেলিয়ে দিতেন বলে উল্লেখ আছে।
এবার একটু উপমহা দেশের প্রেক্ষাপট দেখা দরকার।
খ্রি:পূর্ব একহাজার বাছর আগে(আজ থেকে ৩০০০বছর পূর্বে) প্রচীন বৈদিক ধর্মের ব্যপক অবক্ষয় শুরু হলে আন্ত:উপমহাদেশীয় সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন ধর্ম ও দর্শনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। এর কাছাকাছি কয়েক শতাব্দির মধ্যেই জন্মলাভ করে বৌদ্ধ ধর্ম এবং বিস্তৃতি লাভ করে জৈন ধর্ম। বুদ্ধের অহিংসা ও সাম্যেরবানী বিস্তার লাভ করতে থাকে দিকে দিকে। এবং খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতকের দিকে ব্রাহ্মণরা প্রচীন বৈদিক ধর্মের একটি অমানবিক সংষ্কার করেন। সমাজকে চার স্তরে ভাগ করে ফেলেন তারা। সবার উপরে ব্রাহ্মণ এরা ভগবান তুল্য, এরা ভগবানের মুখ থেকে জন্ম লাভ করেছে এবং ব্রাহ্মণের সন্তানরাই হবে ব্রাহ্মণ। অতপর ক্ষত্রীয়, এরা যোদ্ধা এরা ভগবানের বাহু ও বুক থেকে জন্মেছে। বাকি রইল বৈষ্য ও সুদ্র, এরা ভগবানের নিম্নাঙ্গ থেকে সৃষ্টি। দীর্ঘ কাল ব্রাহ্মণরা তাদের অপছন্দনীয় জন মন্ডলিকে ভগবানের নিন্মাঙ্গে পাঠিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অপমান জনক পরিচয়ে অভ্যস্ত ও অনুদাস করে তুলতেন। এই হীনতা বয়ে চলেছে হাজার হাজার বছর ধরে।
আজ থেকে প্রায় বারশ বছর আগে মুসলমানরা উপমহাদেশে আক্রমন কারী হিসেবে দেখা দেয় এবং লুটতরাজ করে এরা ফিরে যেত। একসময় স্থায়ী ভাবে রাজ্য ক্ষমতা দখল করে তারা এবং ধর্ম প্রচারের চেস্টা করে।

আবার আসি বাংলার প্রেক্ষাপটে।

খ্রিষ্টিয় পাঁচ-ছয় শতকের কথা। গুপ্ত শাসন থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। শৈব ধর্মাবলম্বী শশাঙ্ক নামক এক বাঙালী বাংলার স্বাধীন নৃপতী। বুদ্ধের অহিংস বানী তখন কৌমের প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নৃপতী শশাঙ্ক নির্মম ভাবে দমন করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেন নি। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা জনমন্ডলীতে প্রভাব বিস্তার করতে ব্যার্থ ।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় একশ বছর ছিল বাংলার অরাজকতার যুগ। অতপর জনগন সংখ্যা গরিষ্ঠের ধর্ম- বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, রাজশাহীর গোপালকে রাজা নির্বাচন করেন। শুরু হয় পাল যুগ। চারশত বছর এই রাজ বংশ শাসন করেছে বাংলাদেশ।
অত:পর কর্নাটক থেকে আগত ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনরা চক্রান্ত করে দখল করে বাংলার ক্ষমতা। কাশ্মীর সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমদানী করে কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণ। সমাজকে ভাগ করার চেষ্টা করে চার শ্রেণীতে। স্থানীয়রা চলেযায় ভগবানের নিন্মাঙ্গে। ভাষা সংস্কৃতিসহ সর্ব ক্ষেত্রে শুরু হয় বর্ণবাদীদের অমানবিক শোষন। (হাজার বছর পর পাক আমলে- খান'রা যার পুনারাবৃত্তি করেছিল।)
সেন'রা নিরহ জনগোষ্ঠির এক অংশকে বেধে ফেলে বর্ণাশ্রম প্রথার মধ্যে। যাদের অনেকেই আজ হিন্দু ধর্মের ব্যানারের তলে। শুরু হয় বাংলার নতুন সাম্প্রদায়ীক যুগ। সংখ্যা গরিষ্ঠ স্থানীয় বৌদ্ধ বাঙালীরা মানতে পারেনি সেনদের শোষন।
অতপর খ্রিষ্টিয় বার শতকের দিকে বখতিয়ার খিলজি বাংলা আক্রমন করলে পালিয়ে বাঁচে গনবিচ্ছিন্ন সেন রাজারা।
শুরুহয় মুসলিম শাসনের যুগ। মুসলমান সুফি দরবেশদের মরমী মতবাদের সাথে বুদ্ধের অহিংস মতাদর্শের মিল পেয়ে জনগন দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। ঐ সময়ে বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের সম্পর্ক বাংলা দেশে এতটাই ঘনিষ্ঠ রুপ লাভ করেছিল যে খিলজির গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতো বৌদ্ধ ধর্ম গুরু শ্রমনগন।ধিরে ধিরে সংখ্যা গরিষ্ঠ বৌদ্ধরা রুপান্তরীত হতে থাকে বাঙ্গালী মুসলমানে।বাঙালী মুসলমানদের ঐ সময় থেকেই ব্রাহ্মণরা গালী দিত ন্যাড়ার পো বলে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ এলায়েন্স পরিচিত হতে শুরু করে হিন্দু হিসেবে। ( যদিও উপমহাদেশের বাইরের লোকেরা হিন্দুকুশ পর্বতের পূর্বদিকের সব লোককেই হিন্দু বলে চিহ্নিত করত।) ঐ সময় থেকে অনেক অন্তজ হিন্দুরাও মুসলমান হতে শুরু করে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরাজিত ব্রাহ্মণদের জোর করেই ইসলামে দীক্ষাদেন অনেক মুসলিম শাসক।এসব অনেক দিন ধরেই চলছিল।যে ব্রাহ্মণরা মুসলমানহতো তাদের আত্মীয়রা হিন্দু সমাজে পরিচিত হতো পীরালী ব্রাহ্মণ হিসেবে, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরা ছিল পীরালী ব্রাহ্মণ।হতে পারে ব্রাহ্মণদের উন্নাশীকতাই ছিল এর জন্য দায়ী।( এও এক নিয়তি যে, ভারতের অন্য অঞ্চলের ব্রাহ্মণরা বাঙ্গালী ব্রাহ্মণদের সুদ্রের মতো মনেকরে।) আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ কন্যাকে জোর করে বিয়ে করতো মুসলমান যুবকেরা। কখনো হিন্দু মেয়েরা সহ-মরনের হাত থেকে বাঁচতে পীরের দরগায় এসে মুসলমান হতো। খিলজি এবং পরবর্তি দাস শাসন শেষে বাংলায় স্বাধীন সুলতানী যুগের শুরু হয়।কালের এক পর্যায়ে মোঘলরা ক্ষমতা দখল করে। ইংরেজদের পূর্বে মুসলিম শাসনামলের অধিকাংশ সময়েই বাংলা শাসিত হয়েছে বহিরাগত মুসলমান শাসকদ্বারা। যারা খুব কমই এদেশে স্থায়ী ভাবে থেকেছে। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে এরা পারি জমাতো দিল্লীর দিকে। মজার বিষয়, যে দিল্লী মুসলিম শাসনের কেন্দ্র ছিল প্রায় সাতশ বছর, সেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। সংখা গরিষ্ঠ হলো  জল কাদার এই বাংলাদেশে। এটি হয়ে ছিল বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ধর্মান্তরনের ফলে।
প্রধানত বাঙ্গালীবৌদ্ধ অত:পর হিন্দু-ব্রাহ্মণ,বহিরাগত মুসলমান ও অন্যান্য ধর্ম গোষ্ঠির সম্মিলনে জন্ম নেয় বাঙ্গালীমুসলমান। বাঙ্গালী মুসলমানরাই হলো বাঙ্গালীত্বের প্রধান স্তম্ভ।
কিন্তু দুঃখ বাঙ্গালীকে ছারলো না। প্রাচীন বাংলায় জন্ম নেয়া ব্রাহ্মণ্যবাদী ও বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়ীকতা বিবর্তীত হলো বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়ীকতায়। কালে কালে হিন্দু সাম্প্রদায়ীকতা এতটাই কঠিন রূপ নিয়েছিল যে, দির্ঘ ব্রিটিশ শাসনের শেষে যখন স্বাধীন হওয়ার সুযোগ এল, ১৯৪৭ সালে, বাঙ্গালী মুসলমানরা চাইল অখন্ড বাংলা। কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়ীকতা বাংলার পশ্চিম অংশ ভেঙে নিয়ে গেলো ভারতে। আর বাঙ্গালীমুসলমানরা যে পাকিস্তান বানিয়েছিল- তারাও সেখানে নিগৃহীত হলো পঞ্জাবী খানদের হাতে। অতপর বয়েগেলো রক্ত নদী। স্বাধীন হলো বাংলাদেশ।
কিন্তু বাঙ্গালীমুসলমান, ন্যড়ারপো'রা কী ভুলেগেলো তাদের ইতিহাস ! বিষ্মৃত হলো কী তাদের পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য ! তা না হলে কেন ঘটছে রামুর বৌদ্ধ বসতিতে হামলার মতো আত্মঘাতী ঘটনা। কেন আমাদের ( পূর্ব পার্ট ) সংখ্যালঘু বাঙ্গালীবৌদ্ধরা অসহায় এদেশে। যে দেশ শাসীত হচ্ছে তাদেরই স্ব-জাত দ্বারা ! কেন অবহেলিত আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জলতম পূর্ব পুরুষ অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ? আজও যার প্রর্বতীত লামা ধর্মের  অনুসারি প্রায় দুকোটি। আজও যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচ জন ব্যাক্তির এক জন অথচ আমাদের সন্তানরা জানেনা তার নাম। কেন এই অন্ধকার! জানিনা।

তবে আশা অনন্ত। হয়তো কেটে যাবে এই অন্ধকার । জাতি জাগবে নতুন আলোয়। তবে ক্ষত হয়ে রইলো রামুর এই আত্মঘাতী ঘটনা । যদিও শোনা যাচ্ছে এর সাথে বিদেশী চক্রান্তকারীরা জড়িত। তবু রামুর নিরহ মানুষগুলোযে আমাদের স্বজন!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন